Breaking News

গল্পঃ "ভালোবাসি | লেখাঃ 'উম্মে হাবিবা তানহা'

ছেলেটাকে রোজ এই সময় টাতে রেল-লাইনের পাশে দেখি।চোখে মোটা ফ্রেমের একটা চশমা,হাতে একটা ব্যাগ, সাথে একটা গিটার নিয়ে রোজ রেল-লাইন ধরে হাঁটে বিকাল বেলায়।দেখতে আহামরি সুন্দর নয়।তবে বেশ মায়াবী তার চোখ দুটো।চশমার আড়ালে দেখতে খুব কষ্ট হয়।কিন্তু অনেক কষ্টের বিনিময়ে ছেলেটার সাথে নির্লজ্জের মতো চোখাচোখি করি।হয়তো ছেলেটা বিব্রত হয়, আমিও কিন্তু কম বিব্রত হই না।কিন্তু কি করবো ভালো লাগে যে ওর চোখ দুটো।কখনো ওর সাথে কথা হয় নি।সাহস ছিলো না অতটা কথা বলার।রোজ বিকালে রেল-লাইনে হাঁটতে বের হওয়াটা রীতিমত অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। আর তার কারণ হলো চশমার মোটা ফ্রেমে বন্ধী সেই চোখ দুটো।

সেদিনও একই সময় বের হয়েছিলাম সেই চোখজোড়া দেখার জন্য।কিন্তু ছেলেটি আসলো না। হয়তো অসুস্থ ছিলো তাই আসে নি।মনটা খারাপ হয়ে গেলো।অন্যমনস্ক হয়ে রেল-লাইনের পাথর গুলোর উপর দিয়ে নীরবে এক পা দু'পা করে আস্তে আস্তে হাঁটছি।হঠাৎ দূর থেকে ছেলেটাকে দেখলাম আসছে।আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলাম।জানিনা ওকে দেখলে কেন এতোটা ভালো লাগে? হয়তো ওকে খুব ভালোবাসি।যখন ও আমার সামনে দিয়ে পথ অতিক্রম করে তখন মনে হয় হার্টবিট বেড়ে যায়।আস্তে আস্তে ছেলেটা আমার পাশ দিয়ে পথ টা অতিক্রম করছিলো আর সেই মূহুর্তে চোখাচোখি টা হয়ে গেলো।তারপর ও চলে গেলো দৃষ্টির অগোচরে। আর আমি বাসায় চলে আসলাম।

আমার রুমের জানালা টা একদম রেল-লাইন ঘেসে রয়েছে।অর্থাৎ জানালার পাশে এসে বসলে রেল-লাইনটার অনেক দূর সীমানাতে দৃষ্টি যাওয়া আসা করতে পারে।পরের দিন সকাল বেলা জানালার পাশে বসে একটা দুইটা করে বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছি।হঠাৎ গিটারের আওয়াজ কানে আসলো।গিটারের শব্দ আমার ভীষণ প্রিয়।তাড়াহুড়ো করে বই বন্ধ করে জানালাটা খুলে দেখলাম সেই ছেলেটি।আমার জানালার কাছ থেকে একটু দূরে রেল-লাইনের সাইডে বসে গিটার বাজাচ্ছে।

আর আমি দিব্য মনোযোগ দিয়ে তার গিটারের শব্দগুলো মনে গেঁথে নিচ্ছি।ইচ্ছে করছে এক দৌড়ে ওর কাছাকাছি যাওয়ার জন্য।কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়।এসব ভাবছি ঠিক সেই মূহুর্তে মা ডাকলেন,
-নীলা, এদিকে আয় তো একটু।(আমার নাম নীলা)
-জ্বী মা।আসছি।
-নীলা, মিলা কে স্কুলে নিয়ে যেতে হবে।(মিলা আমার ছোটো বোন)
-ঠিক আছে মা।
মিলা'কে নিয়ে আমি স্কুলের উদ্দেশ্যে বের হলাম।কিন্তু কোথাও ছেলেটাকে দেখতে পেলাম না।ও মনে হয় এতক্ষণে চলে গেছে।আমি মিলাকে স্কুলে দিয়ে চলে আসলাম।
আজ পহেলা ফাল্গুন।ঋতুরাজ বসন্ত ফুলের সমারোহ নিয়ে আমাদের দেশকে রাঙ্গিয়ে দেওয়ার জন্য চলে আসলো।
শীত এখন যাই যাই করছে।কিন্তু এবারের পুরোটা শীতকাল আমার খুব ভালোই কাটলো।অর্থাৎ শীতজুড়ে প্রতি বিকাল ঐ ছেলেটার সাথে দেখা হতো।
ভাবছি ২টা মাস চোখাচোখি করলাম।কিন্তু কথা হলোনা।আজ বিকালে ছেলেটা আসলে ওর সাথে কথা বলবো।
অপেক্ষা বিষয়টা বড্ড কষ্টের।আজকের দিনটা গড়িয়ে বিকাল হতে এতো সময় লাগছে যে খুব বিরক্ত লাগছে।যাই হোক অনেক কষ্টে দুপুরটা পার করলাম।

প্রায় বিকাল হয়ে আসলো।আমি বাসন্তী কালারের একটা শাড়ী পরে হাতে লাল কালারের কাঁচের চুড়ি পড়লাম।আর খোলাচুলে ফুল লাগিয়ে বের হলাম আজকের উদ্দেশ্য সফল করার জন্য।

এক পা দু'পা করে এগোচ্ছি রেল- লাইন ধরে।আর ভীষণ আনইজি ফিল করছি।কিভাবে যে কি বলবো ছেলেটাকে সেটাই বুঝতে পারছি না।কিন্তু আমি বের হয়ে আসার পর অনেকটা সময় পার হয়ে গেলো।কিন্তু ছেলেটা এখনো আসছেনা।তার মানে ও আসবেনা নাকি?কিন্তু ও তো প্রতিদিন আসে আজ কেন আসবেনা? তবে কি ওর সাথে আজ কথা হবে না?

বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো।কিন্তু আজ আর ছেলেটা আসলো না।আমি বাড়িতে চলে আসলাম।
তবে অনেকদিন পর এত্ত বড় একটা আঘাত পেলাম! আমার ভীষণ খারাপ লাগছে।দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ কাঁদলাম।কাঁদলে মন টা নাকি হালকা হয় সেই চেষ্টা করলাম।
আজ ভালোবাসা দিবস।সকাল সকাল রুপা ফোন দিলো।(রুপা আমার বেষ্টফ্রেন্ড)।
-কিরে কি অবস্থা তোর?
-ভালো নারে।রুপা'কে ছেলেটার ব্যাপারে সবটাই বললাম।বলার পর ও বললো,
-ছেলেটার সাথে কথা কেন বললি না?
-ভয় করতো ভীষণ তাই।
-আচ্ছা মন খারাপ করিস না।আজ আসলে ওর সাথে কথা বলিস।
-হুম তাই ভাবছি।তুই একটু আসবি?
-আমি ? আজ কিভাবে আসবো?আজ আমার একটু কাজ আছে।
-আচ্ছা ঠিক আছে।তাহলে থাক।তুই বরং তোর কাজটা শেষ কর।আমি ছেলেটা আসলে ওর সাথে কথা বলবো।
-ওকে তাই করিস।আমি তাহলে রাখছিরে নীলা।
-ওকে দোস্ত। ভালো থাকিস।
খোদা হাফেজ।
ফোনটা রেখে আরেকটু ঘুমালাম।সত্যি বলতে কি এসব ভালোবাসা টালোবাসা দিবস আসছে কেবল আমরা সিঙ্গেলরা শান্তিতে ঘুমানোর জন্য। আর ফেসবুকে পুরোটা নিউজফিড জুড়ে প্যারা নেওয়ার জন্য।তো আর কি করার।সারাটাদিন ঘুমিয়ে কাটালাম।

আজ বিকালে ছেলেটার অপেক্ষায় আবার বের হলাম।আজও অনেকটা সময় অপেক্ষা করলাম।কিন্তু ছেলেটা আজও আসলো না।দু'টা দিন আমি ছেলেটাকে খুঁজছি।কিন্তু এখন আর ওকে খুঁজে পাচ্ছি না।আগের দিনের মতোই মন খারাপ করে বাসায় ফিরে আসলাম।

এভাবে প্রায় অনেকদিন কেটে গেলো।প্রতিদিন বিকালে রেল-লাইন ধরে হাঁটতাম।যদি হঠাৎ কোনো একসময় দেখা হয়ে যায় ঐ ছেলেটির সাথে এই আশায়।কিন্তু না আজ কতো দিন পার হয়ে গেলো।ছেলেটার সাথে আর দেখা হলো না।

আমার দিনগুলো মনে হচ্ছে ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।কিচ্ছু ভালো লাগে না।এভাবে পার হয়ে যাচ্ছে আমার দিন।একপ্রকার হন্নে হয়ে খুঁজলাম ঐ ছেলেটাকে।আর দেখা পেলাম না ছেলেটার।খুব ইচ্ছে ছিলো কিছু কথা বলার ঐ ছেলেটাকে।কিন্তু সে কথাগুলো প্রকাশ করার জন্য সময় বা সুযোগ আমার আসলো না।আসবে কি করে? আমি তো ঐ ছেলেটাকে হারিয়ে ফেলেছি।তবে আজকাল মাঝে মাঝে একটা ভুল বারবার হয়ে যায়।মোটা ফ্রেম বা হাতে অথবে কাঁধে গিটার ঝুলানো থাকলে ভাবি এই বুঝি সেই হারিয়ে ফেলা ছেলেটি।পেঁছন থেকে দৌড়ে গিয়ে যখন সামনে গিয়ে দেখতে পাই না এই ছেলেটি সেই ছেলেটি নয় তখন আবার নিজের গন্তব্যে ফিরে আসি।এইভাবে ভুল আর ঠিকের মাঝে আমার বাস্তব এবং কল্পনা অতিক্রম হচ্ছে।আজকাল আর হাসতে ইচ্ছে করে না।মনে হয় ও হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আমার সব হারিয়ে গেলো।আমার হাসি আমার চঞ্চলতা সব হারিয়ে গেছে।মাঝে মাঝে খুব রাগ হয়। ও এতোটা সময় আমাকে দেখলো কিন্তু ও কি বুঝতে পারলোনা? যে আমি ওকে কতটা জায়গা দিয়েছি হৃদয় জুড়ে! বেশ তো আমার সাথে চোখাচোখি করতো একটুও কি বুঝলো না? ইচ্ছে করেই কি হারিয়ে গেলো আমার জীবন থেকে?একটা মানুষ কি করে এভাবে হারিয়ে যেতে পারে?এভাবে অনেকগুলো প্রশ্ন জমা হলো আমার হৃদয়ের গুপ্ত ঝুড়িতে।যার কোনো উত্তর
আমার জানা নেই।

আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেলো একটা বছর।
আজ আবার শীতের সেই সময় টা শুরু হলো।আজ স্মরণীয় দিনগুলো স্মৃতির দুয়োর ভেদ করে মনের দরজায় এসে কড়া নাড়ছে।আজও আমি খুঁজি সেই নাম না জানা অজানা অচেনা মোটা চশমার ফ্রেমে বন্ধী সেই চোখজোড়া।

আজ আমরা রেল-লাইনের পাশে যে বাসাটি তে থাকতাম সেটা পরিবর্তন করে চিটাগাং নিজের বাড়িতে চলে আসলাম।তবে আমি ঐ ছেলেটিকে খুঁজে পাওয়ার আরেকটি জায়গা হারালাম।আর হয়তো কখনো খুঁজে পাবোনা তাকে।যে আমার হৃদয় জুড়ে থাকে।
আমার চট্টগ্রামের সময় গুলো বড্ড ভীষন্ন লাগতো। মিস করতাম সেই রেল-লাইনটিকে।যেখানে আমার প্রথম ভালোবাসার উৎপত্তি।আবার হারিয়ে ফেলার বেদনা।প্রতিটা স্মৃতি রেল-লাইনের আনাচে কানাচে প্রতিফলিত।
১৪/০২/১৮.
আজ আরেকটি ভালোবাসা দিবস আসলো আমাদের সকলের জীবনে।তবে আজকের দিবস টি তে আমার জীবনের সব থেকে বড় প্রাপ্তি আমি খুঁজে পেলাম।আজ আমি যখন পত্রিকা টি খুললাম ঠিক তখন পত্রিকাটির পাতায় অর্ধেক জুড়ে কিছু লিখা ছিলো অথবা জীবন্ত কিছু বার্তা।
পত্রিকা তে কথাগুলো ঠিক এভাবেই ছিলো,
......নীলা,
ডটগুলো তে কী লিখবো বুঝতে পারলাম না।তাই ডট্ দিয়ে গেলাম।জানি তুমি ভালো নেই।তাই মিথ্যে আশা করছি না।স্বার্থপরের মতো নিজের স্বপ্নগুলো পূরন করতে গিয়ে যখন ভাবলাম সব পেয়ে গেছি,তখন পেছনে ফিরে দেখি,যা পেয়েছি তার থেকেও অনেক বেশি হারিয়েছি।জানো নিজেকে কখনো নিজের কাছে ব্যাখ্যা করা যায় না।তেমনি আমিও আমাকে কোনোদিন নিজের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারিনি।তার জন্যই আমি অনেক বড় একটা সম্পর্ক শুরু হওয়ার আগে হারিয়ে ফেললাম।আমার আজ খুব মনে পড়ছে সেই দিনের কথা যেদিন আমি কোনো উপায় না পেয়ে চলে গিয়েছিলাম গন্তব্যহীন ঠিকানায়। জানো নিঃসঙ্গ জীবনে মানুষ শুধুই স্বপ্ন দেখতে পারে।কিন্তু তা কখনো পূরণ হয় না।স্বপ্ন আসলে কুয়াশার মতো,অল্প সময়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।নীলা আমি তোমার সঙ্গ চাই।লুকিয়ে অনেকটা ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে।জানো আমার জীবনের ডায়েরির প্রতিটি পাতাজুড়েই কেবল নীলা। কয়েকদিন যাবত সেই রেল-লাইনটির পাশে তোমার জন্যই অপেক্ষা করি।আর তোমাকে খুঁজে পাইনা।তোমার বাসায় গিয়ে দেখলাম সেখানে অন্য লোক।বাসাটাও পরিবর্তন করে ফেলেছো।আমি হারাতে পারবোনা তোমাকে নীলা।

জানিনা তুমি আমাকে মনে রেখেছ কিনা? তবে আমার বিশ্বাস আমি তোমাকে হারাবো না।আগামীকাল সেই রেল-লাইনের পাশেই তোমার জন্য অপেক্ষা করবো। আমি জানি তুমি আসবে।আমাদের গল্পের সূচনাটা আমার হাতে ছিলো না।কিন্তু উপসংহার টা কি আমরা দু'জনে লিখতে পারি না?

--"মোটা ফ্রেমের চশমায় বন্ধী তোমার সেই গিটারওয়ালা"
লেখাটুকু পড়ে আমি সাথে সাথেই রওনা হয়ে গেলাম আমার সেই পুরোনো জায়গার উদ্দেশ্যে।আমার অপেক্ষার আজ অবসান ঘটবে।
 

কোন মন্তব্য নেই